শোষিত অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালি জাতিকে মুক্তির দ্বার প্রান্তে এনেছিল যে ভাষন সেটাই হল ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ ভাষন।জাদুমুগ্ধ এই ভাষনটি তুলনামূলক বিশ্লেষনে যেমনি আপন বৈশিষ্ঠ্যে অনন্য, তেমনি বিশ্ব বরেন্য শ্রেষ্ঠ ভাষনগুলোর সাথে তুলনীয়।বঙ্গবন্ধুর এক হাজার একশত সাতটি শব্দের ১৯ মিনিটের এই কালজয়ী ভাষনে যেমনি কোন বিরক্তকর পুনরাবৃত্তি নেই,কোন বাহুল্য নেই,তেমনি আছে শুধু সারকথা,সারমর্ম।দু একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি থাকলেও তা বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্যককে বেগমান করেছে।যোগাযোগ বিজ্ঞান অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ ভাষনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল ১. Good beginning for speech তথা ভাষনের চমৎকার সূচনাপর্ব ২.জনযোগাযোগে speech idiom ব্যবহার ৩. Ask question and then answer এর ব্যবহার ৪. Declarative system ৫. শ্রোতা উদ্ধুদ্ধ ও অনুপ্রানিতকরন প্রক্রিয়া ৬.যুক্তিবিন্যাস ও তথ্যচয়ন প্রক্রিয়া ৭.Put up the attribution first নীতিমালা ৮. Agenda setting function ৯. Humanistic approach ১০. Status conferral function ১১.Possing a challenge ১২.Don’t dragout conclusion ১৩.Public address system ১৪. Humanistic kindness প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধুর ভাষনে উপরিউক্ত সকল নিয়মাবলীর উপস্থাপন পাওয়া যায়। পেরিক্লিসের ভাষন বনাম বঙ্গবন্ধুর ভাষন: প্রাচীন গ্রীসের বক্তৃতাবিদ্যার পারদর্শী শিক্ষক পেরিক্লিসের বাগ্মিতা ছিল অসাধারন।তিনি তার বক্তব্যে বিবেকমান মানুষকে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহনের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন।সে ভাষনে যোগাযোগ বিজ্ঞানের ১৪ টি গুনের Humanistic approach, don’t dragout conclusion, Possing a challenge সহ ৫ গুনাবলী অনুপুস্থিত ছিল। আব্রাহাম লিংকন বনাম বঙ্গবন্ধুর ভাষন : আব্রাহাম লিংকনের ভাষনে গৃহযুদ্ধ জয়ের পর জাতীয় ঐক্যের আহ্বান ছিল সে ভাষনে।গনতন্ত্র সম্পর্কে আজ থেকে ১৫৩ বছর আগে ১৮৬৩ সালে ১৯ শে নভেম্বর গেটিসবার্গে মাত্র ২৭৮ শব্দের ৩ মিনিটের সে ভাষনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন উক্তি করে বলেছিলেন ” That government of the people by the people and for the people, shall not perish from the earth.তার এই ভাষন বিশ্লেষনে যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হল ক. এই ভাষনের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংকটের পরিসমাপ্তি তিনি এর মাধ্যমে টেনেছিলেন। খ.পৃথিবীর সকল গনতন্ত্রকামী মানুষের জন্য তাঁর ভাষনটি সমান গুরুত্ব বহন করে।গ. তাঁর ভাষনটি ছিল লিখিত,পরিশীলিত, প্রস্তুতিমূলক ভাষন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাষনে ছিল ক. মুক্তিযুদ্ধের ডাক খ.মুক্তি প্রত্যয়টি বহুমাত্রিক – মুক্তির সংগ্রাম নিরন্তর। তাই সকল মানুষের মুক্তির জন্য এই ভাষনটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ আব্রাহাম লিংকনের ভাষনেপৃথিবীতে শুধু যারা গনতন্ত্র চায় তাদের মুক্তির কথা বলা হয়েছে।গ. বঙ্গবন্ধুর ভাষন ছিল extempore speech অর্থাৎ পূর্বপ্রস্তুতিহীন, অলিখিত কিন্তু অগ্নিগর্ভ ভাষন।তুলনামূলক বিশ্লেষনে আরও প্রতীয়মান হয় যে আব্রাহাম লিংকনের ভাষনের সময়ের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষনের সময়ের পরিবেশ ছিল অতি নাজুক, সংকটময় ও উত্তাল।তাই তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিচারে বঙ্গবন্ধুর ভাষনটিই শ্রেষ্ঠ ও অনন্য। উইনস্টন চার্চিল বনাম বঙ্গবন্ধুর ভাষন: বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষনকে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় প্রদত্ত বেতার ভাষনের সাথেও তুলনা করা যায়।১৯৪০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।২য় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ জাতি ও সৈনিকদের উদ্ধুদ্ধ করার জন্য চার্চিলতাঁর ভাষনে বলেছিলেন “We shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds,we shall fight in the fields and in the streets,we shall fight in the hills,we shall never surrender অর্থাৎ আমরা সমুদ্রতীরে,স্থলে,মাঠে,রাস্তায়,পাহাড়ে যুদ্ধ করব, আমরা কখনোই আত্মসমার্পন করবনা।তিনি আরো বলেছিলেন “I can give you blood and toil and sweat and tearsঅর্থাৎ আমি আপনাদেরকে দিতে পারি রক্ত- শ্রম,স্বেদ ও চোখের জল।তাঁরভাষন বিশ্লেষনে বলা হয় ” His rich prose and the measured cadeness of his speeches gave the British a sense of the majesty of their history.তাঁর ভাষন ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ কেন্দ্রিক অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষন ছিল দেশের মুক্তির জন্য। মার্টিন লুথার কিং বনাম বঙ্গবন্ধুর ভাষন: বর্ণ- বৈষম্যবাদ বিরোধী আমেরিকার কালো মানুষের প্রিয় নেতা মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালের ২৮ শে আগস্ট তাঁর ঐতিহাসিক ভাষনে বলেছিলেন ” I have a dream, dream is equality ” তিনি আরো বলেছিলেন “I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed.we hold these truths to be self evident,that all men are created equal.I have a dream that my four children will one day live in a nation where they will not be judged by the colour of their skin but by the content of their character. অর্থাৎ আমার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন এ জাতি জাগ্রত হবে এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসের সঠিক অর্থ বুঝবে।আমরা সাক্ষ্য হিসেবে এই সত্যগুলোকে রাখতে পারি যে সকল মানুষকে বানানো হয় সমান করে।আমার একটি স্বপ্ন আছে যে আমার চার সন্তান একদিন এমন একটি জাতি হয়ে বাস করবে, যেখানে তাদের গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবেনা বরং চারত্রিক কাঠামোই হবে তাদের পরিমাপক।তাঁর এই ভাষনে পৃথিবীতে যেখানেই মানুষ বর্ণ বৈষম্যের শিকার হবে তার পরিত্রানে এটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষনে সারা পৃথিবীর যেখানেই মানুষ মুক্তি বঞ্চিত হবে সেখানেই ভাষনটি অর্থবহ।কারন তাঁর ভাষনে সুস্পষ্ট ঘোষনা ,এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
উপরের সকল সেরা ভাষন বিশ্লেষনে প্রতীয়মান হয় যে বাগ্মিতা ও শ্রোতার উপর সম্মোহনী ক্ষমতার বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষনটি নি:সন্দেহে পৃথিবীর সেরা ভাষন।যোগাযোগ বিজ্ঞানের হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর সেরা ভাষনের ১৪ টি গুনাগুনের সবকটিই একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাষনেই পাওয়া যায়।এছাড়াও শোষিত নির্যাতিত বাঙ্গালির জন্য মুক্তির বার্তা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জনের বার্তা,বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির বার্তা,স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তোলার বার্তা তাঁর ভাষনে উপস্থিত ছিল। অলিখিত,নির্দলীয় ভাষন,কঠিন- কোমলের অসাধারন মিশ্রন সংযুক্ত ভাষন,অপূর্ব অভিব্যক্তি,বাচনভঙ্গি,তেজদীপ্ত কন্ঠসর,গনমুখী ভাষন,অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষনা ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে বাঙ্গালির বিজয় সম্পর্কে পূর্ন আস্থাজ্ঞাপন প্রভৃতির বিবেচনায় ৭ ই মার্চের এ ভাষনটিই শ্রেষ্ঠ।
ফিরোজ আলম, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান, আয়েশা (রা:) মহিলা কামিল ( অনার্স,এমএ) মাদ্রাসা,লক্ষীপুর ও সাধারন সম্পাদক বিএমজিটিএ লক্ষীপুর জেলা শাখা।