যশোরে তরুণীকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা কিসের ইঙ্গিত দেয়?

বিশ্বের সুখী দেশের র‌্যাঙ্কিংয়ে সাত ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ১৪৬টি দেশের তালিকায় ৯৪ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১। [UN-sponsored World Happiness Report 2022 released on Friday (March 18, 2022

প্রশ্ন হলো, আমরা কি আসলেই সুখী? পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কি তাই বলে? গণমাধ্যমের এক সংবাদ মনকে শুধু যে বিষণ্ন করেছে তা নয়, স্তম্ভিত করে তুলেছে। শত শত লোকের সামনে তরুণীকে জুতাপেটা ইউপি সদস্যের, ছড়িয়েছে ভিডিও (প্রথম আলো,১৯ মার্চ ২০২২)।

ঘটনা আসলে কী? ১৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের আবদুলপুর গ্রামে শত শত লোকের সামনে প্রকাশ্যে এক তরুণীকে জুতাপেটা করেছেন ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান। কারণ কী? মামলার এজাহার বলছে, ওই তরুণী স্থানীয় এক লোকের বাইসাইকেলে চড়ে পাশের গ্রামের ওয়াজ মাহফিল থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। আবদুলপুর গ্রামের মোড়ে পৌঁছালে অনৈতিক কাজের অভিযোগ তুলে ইউপি সদস্য আনিসুর রহমানসহ কয়েকজন তাদের আটকে রেখে শত শত মানুষের সামনে জুতা ও লাঠি দিয়ে পেটান। খবর পেয়ে ওই তরুণীর মা–বাবা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।

সেই তরুণীকে প্রকাশ্যে নির্যাতনের দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, শতাধিক মানুষের সামনে তরুণীকে জুতা দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাচ্ছেন ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান। ওই তরুণী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ইউপি সদস্যের পাশে থাকা কয়েক যুবক লাথি মারেন। অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে তরুণীর সঙ্গে থাকা যুবককেও এলোপাতাড়ি মারধর করেন ইউপি সদস্য ও তার সঙ্গে থাকা কয়েক যুবক।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণীর হাত ও পা ধরে রেখেছেন কয়েক যুবক। ইউপি সদস্যের অনুসারী আইয়ুব, ভুট্ট, আবদুল আলীমসহ তিন–চারজন লাঠি দিয়ে তরুণীকে হাত-পায়ের গোড়ালিতে বেধড়ক মারধর করছেন। ওই তরুণীর সঙ্গে থাকা যুবককেও নির্যাতন করতে দেখা যায়। (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ ২০২২)

এইখানে কয়েকটি প্রশ্ন স্পষ্ট। প্রথমত, বাইকে করে ওয়াজ মাহফিল থেকে তরুণ আর তরুণী ফিরছিলেন। এত রাতে তারা যে অনৈতিক কাজ করছিল তা কি স্পষ্ট? একদমই না। ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান ও দলবল এতরাতে সেখানে কী করছিলেন? ধরে নিচ্ছি, তারা অনৈতিক কাজ করছে (যদিও তার প্রমাণ নেই) তাহলে তাদের এইভাবে জুতা পেটা করার সাহস পেলেন কী করে?

আমি ভিডিও দেখেছি। এইখানে আনিসুর রহমানের প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিষয়টি পূর্বের কোনো শত্রুতা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা গ্রামে প্রায়শই ঘটে। পূর্বে শত্রুতার জেরে নিরপরাধ মানুষকে বলি দেওয়া হয়। না হয় এইভাবে এত রাতে, এত লোকের সামনে কোনোভাবেই কাউকে নির্যাতন করা যায় না। এইটা অনৈতিক।

আরও পড়ুন: সমাজ তোমায় চপেটঘাত

বিচারহীনতা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ছাত্রলীগ কর্মীরা ধর্ষণ করেছিল তার কি বিচার হয়েছিল? হয়নি। তাহলে কেন ইউপি সদস্য আনিসুর রহমানের বিচার হবে? গণমাধ্যম বলছে, অভিযুক্তরা এখন জামিনে মুক্ত। যেখানে অসংখ্য মানুষ যে ভিডিও দেখেছে সেই জায়গায় আনিসুর রহমান ও তার দলবল যদি জামিনে মুক্তি পায় তাহলে কি এই দেশে বিচার আশা করা যায়?

নারীর রাতে ফেরা সবসময় একশ্রেণির মানুষের কাছে আপত্তির কারণ। তাই তারা সবসময় নারীকে বিভিন্ন সংজ্ঞায় ফেলতে চায়। এই সংজ্ঞা তাদের নিজেদের তৈরি। কখনো পোশাক ভালো না, কখনো চরিত্র খারাপ, কখনো নারী নিজে ভালো না। এইসব ব্যাখ্যা চলতেই থাকে।

কয়েকদিন আগে বাসে টি-শার্ট পরা এক তরুণীকে বোরকা পরা নারী অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। পরে গণমাধ্যমে জানা গেল, বোরকা পরা সেই নারী নিজের খদ্দের হারিয়ে উগ্র হয়ে গিয়েছিল।

আরও আগে ফিরি। করোনার সময় রোগতত্ত্ববিদ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিন মিডিয়াতে এসে প্রেসব্রিফিং করতেন। তখন তার শাড়ি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই গণহারে সমালোচনা করেছেন। সমালোচনার বিষয় ছিল, তিনি প্রতিদিন এত শাড়ি কেন পরেন? আমি সত্যি বুঝি না, এইটা কেন সমালোচনার বিষয় হবে।

২০১৭ সালে সিলেটের জকিগঞ্জের কলাছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘুমন্ত শিক্ষিকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ। অসুস্থ শিক্ষিকাকে সামাজিকভাবে হেনস্থা করার পর চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ বলেছিলেন, ঘুমন্ত শিক্ষিকার ছবি তুলে ‘ভুল করেননি’।

হুট করে একজন নারীকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা যে অপরাধ, এই সাধারণ জ্ঞান বা বোধ চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদের যেমন নেই তেমনি নেই ইউপি সদস্য আনিসুর রহমানের।

মূল সমস্যা হলো, আমাদের দেশে নারী শ্লীলতাহানি বা নারী নির্যাতন বা নারী ধর্ষণে জড়িত কারো কঠোর শাস্তি হয় না। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে যে যখনই পারে নারীকে ভোগের বলি বানায় অথবা জনসম্মুখে অপমানে মেতে ওঠে। স্পষ্ট উচ্চারণে বললে বলতে হয়, ওয়াজে যেভাবে নারীকে নিয়ে বিষোদগার করা হয় তাদের কি কখনো শাস্তি হয়েছে? শহর থেকে প্রান্তিক সব জায়গায় মানুষের মোবাইলে ওয়াজ চলতে থাকে। ওয়াজ দেখে তারা অনুপ্রাণিত হয়। প্রভাবিত হয়। তখন তাদের মন নারীদের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে বাধ্য করে। এই সরল বিষয়টা কেউ বুঝতে চাই না।

‘বাংলাদেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ: সামাজিক-আইনি দৃষ্টিকোণ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে জানা যায়, ৮৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। (ইউএনবি, ৩০ এপ্রিল ২০২১)

এই ৮৪ শতাংশ নারী কারা? এই ৮৪ শতাংশ নারী তারাই, যারা ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখে। একদিকে নারী স্বাধীনতার কথা বলে আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছি অপরদিকে নারীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের কর্মকাণ্ড উল্লেখ করার মতো নয়। এই দ্বিচারিতা নারীদের শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, নির্যাতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ২০০৯ সালে নগরীর তেজগাঁও থানা চত্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। ২০১১ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অধীনে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চালু করে ডিএমপি। প্রতিদিন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের হটলাইনে অন্তত ২০০ জন যোগাযোগ করেন। এছাড়া ১০ থেকে ১৫ জন সশরীরের অভিযোগ জানান। এই সেন্টার থেকে গত ১০ বছরে নারী ও শিশুদের করা মোট ৪ হাজার ৩৮০ মামলার মধ্যে ২ হাজার ৪০৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ২৩৭ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৩৮ মামলা তদন্তাধীন। (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ ২০২২)

এই তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় নারীদের নিরাপত্তায় যা করা উচিত ছিল তা করা হয়নি।

যশোরের এই ভিডিও দেখে যদি ইউপি সদস্য আনিসুর রহমানের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত তবে এই ধরনের কাজ ভবিষ্যতে হত না। এইধরনের অপরাধ যারা করে তারা ভাবে তারা সঠিক কাজ করেছে। ফলে ভুক্তভোগী পড়েন বিপদে। ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান জামিনে মুক্তি পাওয়ায় এখন যশোরের সেই নারীর পরিবার নিঃসন্দেহে বিপদে আছে। এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রশাসন কখনোই ভুক্তভোগীর পক্ষে থাকে না। যেমনটা অনিরাপদ বোধ করছেন যশোরের সেই নারীর পরিবার। এইরকম অনিরাপদ বোধ করেছেন দেখে আশামনি নামের স্কুল পড়ুয়া সেই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

সমাজ কোনদিকে যাবে তা প্রশাসন বা সরকারের কর্মকাণ্ড বলে দেয় বা ইঙ্গিত দেয়। নারীর প্রতি ঘৃণা বা শ্লীলতাহানি বা নির্যাতন বা ধর্ষণ যে প্রতিনিয়ত বাড়বে তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। কারণ এই দেশে সঠিক বিচার হয় না। এতকিছুর পর কি বলা যায় আমরা সুখী

Related Posts

en_USEnglish