শুক্রবার (২৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিটিভি, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে। নতুন সরকার গঠনের পর এটিই জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বিজয়ের পর আমরা সরকার গঠন করেছি।
বহিঃবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেকোন সময়ের চাইতে সুদৃঢ় এবং গভীর।
দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করবেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব।
নতুন মন্ত্রিসভা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে আমি আমার মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম- এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
তিনি বলেন, আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে যে রায় দিয়েছেন, কথা দিচ্ছি আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব সে আস্থার প্রতিদান দিতে। এজন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের সমর্থন এবং সহযোগিতা চাই। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করব, ইনশাআল্লাহ।
শেখ হাসিনা বলেন, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে চাই:
‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, / এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
বিরোধী জোট থেকে নির্বাচিতদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একাদশ সংসদে বিরোধীদলের সদস্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে, সংখ্যা দিয়ে আমরা তাদের বিবেচনা করব না।
তিনি বলেন, সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যেকোন সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব/আলোচনা/সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমি বিরোধীদলের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের কারণগুলো তুলে ধরে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ছিল খুবই প্রত্যাশিত। নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি জরিপগুলিও এ রকমই ফলাফলের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
তিনি বলেন, লন্ডন-ভিত্তিক ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট এবং রিসার্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সেন্টারের জরিপের ফল আপনারা লক্ষ্য করেছেন। আমাদের এই ল্যান্ড-স্লাইড বিজয়ের কয়েকটি কারণ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
মোটাদাগে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের ১৫ এবং বিএনপির ভরাডুবির ৭টি কারণ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে মন্তব্য করে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা যে প্রতিশ্রুতি দেই, তা বাস্তবায়ন করি। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছিলাম তার অধিকাংশই ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি।
তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ স্লোগান সম্বলিত নির্বাচন ইশতেহার ঘোষণা করেছি। ইশতেহার ঘোষণাকালে আমি এর সারাংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম। আপনারা অনেকেই এই দলিলটি ইতোমধ্যে পড়েছেন।
ইশতেহার বাস্তবায়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের যেকোন নীতিমালা প্রণয়নে এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এই ইশতেহারটি পথ-নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর দায়িত্ব বহুগুণ বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের এই নিরঙ্কুশ সমর্থন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুর্নীতির নির্মূলের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে
তিনি বলেন, আমরা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতি বন্ধে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। তাই, গণমাধ্যমের সহায়তায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির কাজ অব্যাহত থাকবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি সেবাখাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। জাতীয় সংসদ হবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু।
সন্ত্রাস-মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে ইতোমধ্যেই মাদক, জঙ্গি তৎপরতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি থাকবে না। সকল ধর্ম-বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সকলে নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারবেন।
নিজের ব্যক্তিগত কোন চাওয়া পাওয়া নেই উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি- আমার ব্যক্তিগত কোন চাওয়া-পাওয়া নেই।
তিনি বলেন, বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়ে আমি রাজনীতি করছি শুধু জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তাবায়নের জন্য; এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। এ দেশের সাধারণ মানুষেরা যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারেন, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হতে পারেন- তা বাস্তবায়ন করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন: ‘মহৎ অর্জনের জন্য মহৎ ত্যাগের প্রয়োজন।’ আমরা ত্যাগের পথ অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বর্তমানকে উৎসর্গ করেছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
গত ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো মন্ত্রিসভা গঠন করেন শেখ হাসিনা।
এর আগে ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে যে ২৯৯টিতে ভোট গ্রহণ এবং তার মধ্যে ২৯৮টির ফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এই ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২৫৯টি আসন পেয়েছে নৌকার প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে ২৮৮ আসন।
অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হতে পেরেছে।