থ্রিলার, রহস্যে ভরপুর, মারদাঙ্গা সিনেমা নয়। নেই বলিউডের ছায়া। গল্পের পুরোটাজুড়েই যেন বাঙালির অতীত সংস্কৃতির যোগ পাওয়া যায়। গল্প বলা ও উপস্থাপনার ঢং নিয়ে যায় বাঙালির শত শত বছর আগে ফেলে আসা অতীতে। বলছি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘কাজলরেখা’র কথা। ৪০০ বছর আগের একটি প্রেমের গল্প। যে গল্প কাজলরেখাকে ঘিরে। পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের এ সিনেমার পরতে পরতে ছিল মুগ্ধ করার মতো উপকরণ।
বন্দনাসংগীত দিয়েই শুরু হলো এই সংগীতনির্ভর সিনেমা। গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছেন অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিনেতাকে সিনেমায় ভিন্ন পাঁচটি চরিত্রে দেখা গেছে। প্রতিটি চরিত্রে স্বল্প সময়ের জন্য পর্দায় এলেও পাশা খেলার সঙ্গী, জেলে, পুরোহিতসহ সব চরিত্রে আলাদা করে নজর কেড়েছেন। বলা যায়, ছোট-বড় চরিত্রের চরিত্রায়ণগুলোতে সফল পরিচালক।
শুরু থেকেই সিনেমাটি সমান গতিতে এগিয়েছে। তেমন মেদ ছিল না। ছিল পরিচ্ছন্ন সময়ের চিত্র। বিশাল এক পাহাড়ি এলাকা। তার পাশে রাস্তা। পাশেই একটি পুকুর। তার মাঝে একটি ঘর। সেখানে সাধু ধনেশ্বরের পাশা খেলার আসর বসে। সেই আসরের অভিনয়শিল্পীদের সাজসজ্জা, বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘর, ভাষা, শারীরিক অভিব্যক্তি আমাদের নিয়ে যায় ৪০০ বছর আগে।
নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর ছিল শুটিংয়ের লোকেশন। সেখানে তিন মাস ধরে সেট নির্মাণ করা হয়। চরিত্রের কস্টিউম, লোকেশন, আবহ সংগীতের জন্য যে অনেক সময় দিতে হয়েছে, সেটা বোঝা গেল। এক মিনিটের একটি দৃশ্যের জন্য ৪০০ বছর আগের রেঙ্গুনের বাজার তৈরি করা হয়। সেই সময়ের লোকসংস্কৃতি ও বাঙালির ঐতিহ্য দেখতে দেখতে গল্পে ঢুকতে খুব বেশি সময় লাগে না। দক্ষতার সঙ্গে চিত্রগ্রহণের কারণে সিনেমাটি যেন ৪০০ বছর অতীতে ভ্রমণের মতো মনে রসদ জোগাচ্ছিল।
সরলরৈখিক গল্পটাই বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনার কারণে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখে। শুরুতে সাধুর পাশা খেলার দৃশ্য ছিল উত্তেজনায় ভরা। সে খেলায় সাধু সবকিছু হারিয়ে পাগলপ্রায়। রাজা থেকে নিঃস্ব। জুয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় স্ত্রী ও কাজলরেখারা। তাদের নিয়ে নতুন করে আবার শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। এই দুঃসময়ে রহস্যময় সুখপাখি তাঁদের ভাগ্য ফেরাতে আসে। ধনেশ্বর সুখপাখিটি স্ত্রীর কাছে নিয়ে এসে বলেন, ‘এই পাখির কথা শুনলেই বদলে যাবে আমাদের ভাগ্য।’ সাধুর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা সাহানা সুমি এ কথায় তেমন গুরুত্ব দেন না। তিনি বলেন, ‘যে শোনে না মানুষের কথা, সে শুনবে পাখির কথা।’ জীবনের ঘাত–প্রতিঘাতে এবার শক্ত এই সাধু। আবার শুরু করেন বাণিজ্য।
সাধু ধনেশ্বর চরিত্রে বিশেষ করে বলতে হয় অভিনেতা ইরেশ যাকেরের কথা। সিনেমার বড় অংশের হাল তিনিই টেনেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিল কালজরেখা চরিত্রে সাদিয়া আয়মানের অভিনয়। নাটকে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই অভিনেত্রী যখন সিনেমাটি করেন, তখনো তাঁকে কেউ চেনে না। প্রথম সিনেমা হলেও অভিনয়ে জড়তা ছিল না। ছিলেন সময়ের সঙ্গে মানানসই। তাঁর সংলাপ বলার ধরন, অভিব্যক্তি, ১৩ বছরের কিশোরীর চরিত্রে সরলতা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন সুবর্ণা মুস্তাফার মতো অভিনয়শিল্পীসহ অনেকে।
সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলোর পাশাপাশি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রগুলোতে শিল্পীদের অভিনয়ও ছিল উল্লেখ করার মতো। বিয়ের গানের সঙ্গে যখন দাস–দাসিরা ঠোঁট মেলায়, তাদের সেই অভিনয় ছিল অনেক গোছানো। বলতে হয় ৪০০ বছর আগের রাজা চরিত্রের অভিনেতা শরীফুল রাজের কথা। রাজা বুঝতে পারেন, তাঁর দাসি আদতে দাসি নন, হয়তো কোনো এক রাজকন্যা। তাঁর পরিচয় কী? তাঁর প্রতি দুর্বলতা, রাগের মাথায় তাঁকে বাড়ি থেকে বনবাসে পাঠানোর পর রাজার হন্য হয়ে খোঁজার দৃশ্যগুলোতে তিনি ছিলেন মানানসই।