কল্পনা করুন একজন মানুষের সাথে আপনার দেখা হলো।তাকে আপনি চেনেন না। দেখা হওয়া মাত্রই আপনি তাকে একটি মুচকি হাসি উপহার দিলেন। এরপর লোকটির কথা ভুলেই গেলেন। কিন্তু কিছু দিন পরে দেখলেন সেই ব্যক্তি আপনাকে একটি গাড়ি উপহার দিয়ে বলল, ‘আমি আপনার সে হাসির কথা কিছুতেই ভুলবো না। সে হাসিতে আমার প্রতি আপনার সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি।’
এরপর আপনার সে হাসির কারণে ঐ লোক সবসময় আপনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে লাগল এবং আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগল। আপনি একটা বিপদে পড়েছেন, সে এসে আপনাকে সাহায্য করল। এমনিভাবে তার সময়-শ্রম দিয়ে সবক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করল। যখন আপনি অসুস্থ হলেন, সে এসে আপনাকে দেখে গেল এবং আপনার হাতে খাবার তুলে দিল।
তার এই অবস্থা দেখে আপনি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন এবং তাকে বললেন যে, আমি তো এতকিছু পাওয়ার যোগ্য নই। সে উত্তর দিল, ‘না, না, আমি কখনোই আপনার সেই হাসির কথা ভুলতে পারব না। এভাবেই সে আপনার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে যেতে থাকল। এর মধ্যে দুনিয়াবি কোন স্বার্থ নেই।
এই ধরনের মানুষকেই কিন্তু আপনি ‘ওয়াদুদ অর্থাৎ অতি দয়ালু বলে অভিহিত করবেন। এই ধরনের মানুষের দয়া দেখে আপনি প্রচন্ড লজ্জা অনুভব করবেন। বিশেষ করে যখন আপনি নিজে তার সাথে অনুরূপ কিছু করতে অক্ষম হবেন।
আল্লাহর ব্যাপারটিও এমনই। তিনি পরম দয়াময়। সামান্য আমলের বিনিময়ে তিনি তার বান্দাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন, তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তাদের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজেও অনেক বেশি সম্মান প্রদান করেন। হয়তো কাজটি বান্দার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তবুও তিনি তাকে এর বিনিময়ে বিরাট প্রতিদান দিয়ে থাকেন।তবে এই সকল কথা এ কাজের প্রতিদান পাওয়ার জন্য একটাই শর্ত। কাজটি কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হবে।
আপনি রাসূল সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিসের দিকে লক্ষ্য করতে পারেন। তিনি বলেছেন,
ان احدكم ليتكلم بالكلمت من رضوان االله ما يظن ان تبلغ ما بلغت فيكتب الله له بها رضوانه الى يوم يلقاه
“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে ধারণাও করে না যে, তা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তার এই কথার কারণে তাঁর সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তার জন্য সন্তুষ্টি লিখে দেন।” তিরমিজিঃ ২৩১৯
একটি ছোট্ট কথা হয়তো সে বলার পর ভুলেও গিয়েছে। সে কখনও এটা কল্পনাও করতে পারেনি যে, আল্লাহর কাছে তা এত বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই কথার কারণেই তার ওপর অনেক বেশি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।
হাদিসে এসেছে,
لقد رايت رجلا يتقلب في الجنة، في شجرة قطعها من ظهر الطريق، كانت تؤذي الناس
“আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম জান্নাতে একটি গাছের নিচে স্বচ্ছন্দে হাঁটছে। কারণ সে এমন একটি গাছ রাস্তার মধ্য থেকে কেটে ফেলেছে যা মানুষ কে কষ্ট দিত।” মুসলিমঃ ১৯০৫
এটিও কত ছোট্র একটি কাজ! কিন্তু যেহেতু এটি করা হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তাই তিনি এর জন্য বিরাট বড় প্রতিদান দিলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি ভালো কাজকে দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।
যদি আল্লাহর দয়া এবং তার সহিষ্ণুতা নিয়ে চিন্তা করার কারণে আপনার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তবে এই ক্ষুদ্র কাজের বিনিময়েও কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন এবং জাহান্নামকে আপনার জন্য হারাম করে দেবেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে আরশের ছায়া তলে আশ্রয় দেয়া হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলোঃ
رجل ذكرالله خاليا، ففاضت عيناه
“এমন ব্যক্তি, যে কি না নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে। আর এতে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।” বুখারিঃ ১৪২৩
আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عينان لا تمسهما النار. عين بكت من خشية الله، وعين باتت تحرس في سبيل الله.
“দুটি চোখ জাহান্নামের সংস্পর্শে আসবেনা। এক. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। দুই. যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারা দিতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়।” তিরমিজিঃ ১৬৪৫
কাজগুলো কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র! কিন্তু আল্লাহতায়ালা এগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করেন। কারণ তিনি বান্দার কাজের যথাযথ পুরস্কার দিয়ে থাকেন। বান্দা যখন তাঁর জন্য নেক কাজ করে, তখন তিনি তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেন। তিনি বলেছেন,
واستغفروا ربكم ثم توبوا اليه ان ربي رحيم ودود
“তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাঁর কাছে তাওবা করো। নিশ্চয়ই আমার রব দয়ালু এবং দয়াময়।” সূরা হুদঃ ৯০
তিনি আপনার পাহাড় পরিমাণ গুনাহকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন এবং এত বিশাল গুণাহ ক্ষমা করতে গিয়ে তিনি অন্যকিছুর ভ্রুক্ষেপও করছেন না। কারণ ছাড়া একবিন্দু নেকিও তিনি বিনষ্ট করেন না। তিনি বলেছেন,
ان الله لا يضيع اجر المحسنين
“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” সূরা তাওবাঃ ১০২
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من جاء بالحسنة فله عشز امثالها وازيد، و من خاء بالسيئة فجزاؤه سيءة مثلها او اغفر ومن تقزب مني شبرا تقربت منه ذراعا، ومن تقرب مني ذراعا تقربت منه باعا، ومن اتانى يمشي اتيته هرولة، ومن لقيني بقراب الارض خطيئة لا يشرك بي شيئاا لقيته بمثلها مغفرة.
“যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করবে, তার জন্য রয়েছে দশগুণ সাওয়াব; আর আমি তাকে আরও বাড়িয়ে দেব। আর যে ব্যক্তি একটি মন্দ কাজ (গুনাহ) করবে তার প্রতিফলন সেই কাজের অনুরুপ; কিংবা আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে একহাত এগিয়ে আসি। আর যে ব্যক্তি আমার প্রতি একহাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে আসি। যে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে ছুটে আসি। যে ব্যক্তি পৃথিবী সমান গুনাহ করে এবং আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করা থেকে বিরত থাকে, আমি তার জন্য পৃথিবী সমপরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে উপস্থিত হই।” মুসলিমঃ ৬৫৮৯
যে ব্যাপারটা আপনাকে আল্লাহর ব্যাপারে আরও বেশি লজ্জায় ফেলে দেবে তা হলো, আপনি কিন্তু আল্লাহ তাআলার কোন উপকার করতে সক্ষম নন। আল্লাহর এসব দানের প্রতিদান দেওয়াও আপনার পক্ষে অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আল্লাহ তাআলাই আপনাকে নেককর্ম করার তাওফিক দিয়েছেন। নেককাজ করার ইচ্ছা যদিও আপনি করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু এই নেককাজ করার সক্ষমতা আল্লাহ তাআলাই আপনাকে দিয়েছেন। আবার সেই নেককাজ করার কারণে তিনিই আপনাকে প্রতিদান দিচ্ছেন। যখন আল্লাহ তাআলা আপনাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং সবর করার তাওফিক দান করেন, তখন সেই সবরের কারণে আবার তিনিই আপনাকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। চাই সেটা অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে। এগুলোকে আপনি কি বলবেন? এগুলোই হচ্ছে আল্লাহর “আল-ওয়াদুদ” নামের হাকীকত।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বিপদে-আপদে এবং খশি-আনন্দে তাঁকে ভুলে যাব না। পরিস্থিতি যতই মারাত্মক হোক না কেন আমরা তাঁর কাছেই ছুটে যাব। চলুন আমরা আল্লহকে ভালোবাসি।
লেখক: মাওলানা মোঃ মাকছুদুর রহমান
প্রভাষক (আরবি)
হাজিরহাট হামিদিয়া ফাযিল ডিগ্রি মাদরাসা