জাপার বাজিমাত, আ.লীগ-বিএনপির বড় হার

image_pdfimage_print

অনলাইন ডেস্ক:
জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরে ভোটে বড় জয়ই পেল সংসদে প্রধান বিরোধী দলটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা সারাদেশে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি পাত্তাই পেল না বৃহস্পতিবারের ভোটে।
তিন সপ্তাহের নির্ঘুম প্রচার শেষে বৃহস্পতিবার রংপুরবাসী ভোট দিয়েছে উৎসবের আমেজে। বিকাল চারটার পর শুরু হয় ভোট গণনা। আর কিছুক্ষণ পর থেকে আসতে থাকে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল। যত সময় গড়াতে থাকে, ভোটের ফল ততই একপেশে হতে থাকে।
ভোট নেয়া ১৯৩টি কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ভোট পেয়েছেন মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ২০১২ সালের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝণ্টু তার অর্ধেক ভোটও পাননি। তিনি পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিএনপির কাওসার জামান বাবলা পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৬ জন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বৃহস্পতিবার রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন পুলিশ কমিউনিটি হলে বসানো নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে। তবে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই কেন্দ্রওয়ারী ফলাফল জেনে যান তিন প্রার্থীর সমর্থকরা। আর রাত যত গড়াতে থাকে জাতীয় পার্টির সমর্থকদের মধ্যে উল্লাস আর আনন্দ তত বাড়তে থাকে, আর ম্রিয়মান হতে থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্খকরা।
রংপুরে ভোটে অবশ্য বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে কখনও ভালো করতে পারেনি। ফলে এবারও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নৌকা আর লাঙ্গলের মধ্যেই হবে বলে ধারণা ছিল। হয়েছেও তা। তবে ভোটের ব্যবধান গত কয়েক বছরের নির্বাচনগুলোর চেয়ে হয়েছে অনেক বেশি।
২০১২ সালের নির্বাচনেও এই তিন প্রার্থী ছিলেন ভোটের লড়াইয়ে। তবে তখন দলীয় প্রতীকে ভোট হয়নি। ফলে অনেকটা ব্যক্তিগত কারিশমার ওপরও নির্ভর করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু এবার ভোট হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা, বিএনপির ধানের শীষ আর জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের মধ্যে।
গত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ঝণ্টুর ভোট কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর মোস্তফার ভোট বেড়েছে অনেক বেশি। পাঁচ বছর আগে ভোটের আগের দিন বিএনপির বাবলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও ব্যালটে তার নাম ছিল। এবার তিনি ভোট পেয়েছেন গতবারের চেয়ে কিছু বেশি।
২০১২ সালের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমদ ঝন্টু এক লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পান ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট।
সাম্প্রতিক সময়ে যত নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের পর রংপুরের এই ভোটটিই হয়েছে সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ ও উৎসব মুখর। সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ভোট নেয়া ১৯৩ কেন্দ্রের কোনোটিতেই গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি, কোথাও জাল ভোট দেয়ার অভিযোগও উঠেনি, ভোটারদেরকে বাধা দেয়া বা ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে এমন প্রমাণও মেলেনি।
ভোটের সকালেই আওয়ামী লীগর সরফুদ্দিন আহমেদ ঝণ্টু এবং জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ জানিয়ে জয়ের প্রত্যাশা করেছিলেন। তবে বিএনপির কাওসার জামান বাবলা কিছু কেন্দ্রে তার এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ করেন। তবে পরে তিনি আর কোনো অভিযোগ না করলেও রাতে সংবাদ সম্মেলন করে কারচুপির অভিযোগে এনে ফল প্রত্যাখ্যান করেন বাবলা।
ঢাকায় বসে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, বিএনপির এজেন্টদেরকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আর নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।
অবশ্য বিএনপির অভিযোগকে নাকচ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। তিনি বলেছেন, তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, সব জায়গায় ভোট ছিল শান্তিপূর্ণ এবং এ নিয়ে কমিশন সন্তুষ্ট।
আরেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এই ভোটকে মডেল নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মডেল নির্বাচন করার কথা আপনাদের বলেছিলাম। রংপুরে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। একটি মডেল নির্বাচন হয়েছে।’
সন্ধ্যায় বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল যখন আসতে শুরু করে, তখন আগেভাগেই পরাজয় স্বীকার করে নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, রংপুরে ভোটে হারলেও রাজনৈতিকভাবে জয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আসলে জিতেছে জনগণ।
আওয়ামী লীগের আরেক নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক দুপুরে আরেক সংবাদ সম্মেলনে এই নির্বাচনকে পুরোপুরি সুষ্ঠু আখ্যা দিয়ে বলেন, বিএনপি কেন কারচুপির অভিযোগ করছে, সেটা তারা জানেন না।
রংপুরে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা ভোট শেষে জানিয়েছিলেন একজন নির্বাচন কমিশনার। তবে সার্বিক হিসাব পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়ার পর জানা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচনে মেয়র পদে সাত জন এবং ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ২১১ জন এবং ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৬৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মোট ভোটার ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯৬ হাজার ২৫৬ এবং নারী এক লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন।
এই নির্বাচনকে ঘিরে গত এক সপ্তাহ ধরেই রংপুরে আরোপ করা হয়েছে নিরাপত্তার কড়াকড়ি। বহিরাগতদেরকে শহর ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। হোটেলগুলোতেই নির্বাচনী এলাকার বাইরে কাউকে না তোলার নির্দেশ ছিল।
এই নির্বাচনে প্রচার চালাতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা রংপুর সফর করেছেন। ভোটারদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের প্রার্থীকে বেছে নিতে। তবে ভোটাররা নিরাশ করেছেন তাদের।
ভোটে জয়ের আভাস পেয়ে বিজয়ী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘আমাকে ভোট দেয়ায় আমি রংপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। রংপুর সিটিকে একটি বাসযোগ্য নগরী করার জন্য আমি যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছি, তা পূরণ করতে আমি আমার জীবন উৎগর্গ করব।’
মোস্তফা বলেন, ‘আমি নিজে দুর্নীতি করব না, কাউকে দুর্নীতি করার সুযোগ দেবো না।’

Related Posts

en_USEnglish