This is the time of our language

image_pdfimage_print

বায়ান্ন সালের পর থেকে আমাদের সকল আন্দোলন, সমস্ত কিছুর সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা জড়িত হয়ে গেছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কোনো আন্দোলনই মরে যায়। একটা সময় পরে তার আবেদন বা প্রাসঙ্গিকতা আর থাকে না। এ প্রসঙ্গে বলা যায় ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলুশনের কথা। এত বড় প্রভাবশালী ঘটনা, অথচ এখন হয়তো সেই দিনটি পালিত হয় কি হয় না, তার ঠিক নেই।

আমাদের জাতিটা বড্ড বেশি বাক্যবাগীশ। সমাজ যে বদলাচ্ছে; সেই বদলের সঙ্গে আমাদের একুশের আন্দোলন-চেতনার যে সমন্বয় করা দরকার, পরিবর্তনটা দরকার- তা আর কেউ ভাবে না। কারণ ভাবলে অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের সারাটা দেশ গরিব; মানুষ নিরক্ষর, মানুষের মনে কিছু নেই; কিছু মধ্যবিত্ত যুবক আছে, কিছু কাগজ ও টিভি চ্যানেল আছে। আর একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের কিছু কমিটি আছে। তাই দিয়েই কিছু আয়োজন হয়। কিন্তু যদি বলি, শ্বাসে এবং মূলে আমাদের সমাজের ভেতরে একুশ কি ঢুকেছে? উত্তর না-ই আসবে।

সাতচল্লিশের পর থেকে এখন পর্যন্ত, জনসাধারণ যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেল। আর আমরা আশা করতে থাকলাম, জনসাধারণ একুশের চেতনায় জাগ্রত আছে- তাই কি হয়! আপনি গ্রামের মধ্যে নানান রকমের এটা-ওটা ব্যবসা, এনজিও ঢুকিয়ে দেবেন। তাহলে সেই গ্রামটা কি আর কোনোদিন প্রকৃতির সেই শুদ্ধ সাঁওতাল গ্রাম থাকবে! থাকবে না। প্রত্যেক বছরেই একবার এই যে আমাদের একুশের চেতনা, আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরব বলে ঢাক-ঢোল পেটানো হয়; এই ‘আমাদের’ বলতে আসলে কাদের বোঝানো হয়? এই ‘আমাদের’টা আসলে কারা? ‘আমাদের’ শব্দ একটা অত্যন্ত অস্পষ্ট শব্দ। এই শব্দটি দিয়ে বহু কিছু এড়িয়ে যাওয়া যায়।
একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, আমরা বিপরীত মেরুতে চলে এসেছি। একুশের চেতনার ঠিক উল্টো জায়গাটিতে এসে আমরা পৌঁছেছি। আমরা টেবিলের এপারে ছিলাম, টেবিলের ওপারে গিয়েছি- এর বেশি কিছু আসলে হয়নি। এরপর হয়তো এসবও হবে না। কিংবা গ্রামদেশে এখন এসবের কিছুই নেই। কেন থাকবে! থাকার কোনো কারণও নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা মানুষের মধ্যে কাজ যে করবে, সেটা কীভাবে? আজকে প্রায় সত্তর বছর পর কাজ করেছে, তবেই না আগামীতে করবে। তা না হলে মানুষ পিছু হটবে কীভাবে? মানুষ আসলে কেমন করে পিছু হটে?

এ সবকিছু নিয়ে একটা গোলমেলে সাংস্কৃতিক অবস্থা বিরাজ করছে। এর সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সাযুজ্য নেই, শিক্ষার কোনো মিল নেই। এসবের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার প্রথম দায়িত্ব আমরা যারা রাষ্ট্র চালাই, তাদের। তাই বাস্তবতার এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গ্লানি বা হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। আমি কোনো আশার আলো দেখছি না। কারণ এখানে যা কাজ আছে, যা কাজ হচ্ছে, তাতে কোনো রকম পরিকল্পনা নেই চেতনা সংক্রান্ত। চেতনা আছে শুধু কিছু বুলি আউড়ানো আর টকশোর আস্ম্ফালনে। তবু কিচ্ছু হবে না- এ কথা আমার নয়।

একটা দেশের সংস্কৃতিকে উন্নত করতে না চাইলে এবং চাইলে- দু’ক্ষেত্রেই প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অবস্থা ভালো আছে কি মন্দ- এ প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই পড়ে আছে। আমাদের উচ্চশিক্ষার বাস্তব কার্যকারিতাও সবার কাছে অনিশ্চিত। একটা মানুষ এত পড়াশোনা করে কী করবে, আদৌ কী করার আছে এ ব্যাপারে; শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারে না। কেউ যদি আমাকে বলে যে, এত হতাশাবাদী হচ্ছো কেন? আমি বলব, আরে বাবা, হতাশাবাদী হবো না কেন!

সবার জন্য একমুখী শিক্ষা মুখে মুখে বলছি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলগুলোতে বাংলা বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো হয়। বলা হচ্ছে, সবাইকে একই সিলেবাস পড়তে হবে। এ দেশের বড়লোক, এ দেশের ধান্ধাবাজ, এ দেশের আমলারা দেশটাকে বিদেশিদের বাজার বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এদের মধ্যে সৃষ্টি বলে কিছু নেই। তারা লুটপাটে ব্যস্ত। আমরা তাদের মনঃতুষ্টির একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলছি। রাষ্ট্রটি যে সাধারণ মানুষের নয়- তা ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

ভাষা নিয়ে আমরা কী করেছি? আমরা মুখে মুখে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু ভাষা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই করতে পারিনি। যেমন কিছুটা স্ববিরোধী ভঙ্গিতেই আমি বলব, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে মাধ্যম করাটাই ভুল হয়েছে। এ কথা বললে লোকে আমাকে দেশদ্রোহী বলবে। বাংলাকে মাধ্যম করার আগে বোঝা দরকার ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী পড়াই। দর্শন এবং ইতিহাস পড়তে গিয়ে একজন বাংলায় যে বইগুলো পড়ে, তা কি পাঠযোগ্য? বাংলায় দর্শনের ওপরে কোনো ভালো বই নেই। একজন ছাত্র যখন বাংলা বইয়ের মাধ্যমে দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করে তখন সেটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সে ইংরেজি না জানার কারণে দর্শন ভালো করে বোঝে না অথবা অপরদিকে অগোছালো বাংলায় দর্শনকে ভুলভাবে বোঝে। বাংলায় ফিলসফির কোনো বই পড়া যায়? কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাংলায় দর্শনচর্চা সম্ভব নয় বা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়। যত্ন নিয়ে, শ্রম দিয়ে এসবই সম্ভব। আমরা এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা। আমি মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের ওপর অনাস্থা আনতে পারি, কিন্তু বাংলাভাষী কোটি কোটি মানুষের ভাষার ওপর আমার আস্থা গভীর।

বলা হয়েছিল, দেশের মানুষের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দেবে, খাজনাহীন জমি করে দেবে। কিন্তু খাজনাহীন জমি তো দূরে থাক, খাসজমি- সেগুলো যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রইল ৫০ বছর ধরে। কী হবে আমাদের এখানে ভাষা চেতনা, কী হবে আমাদের এখানে আদিবাসীদের সমস্যা? এসবের কিছুই ঠিক করা হয়নি এখনও। আর করলে যে ঢাকার নিজেদেরই চলবে না। এটা হচ্ছে, at the cost of one class। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে- : the hole country has become the country of few.

তবু বলি যে, বাংলাদেশে অন্ততপক্ষে ৩৪ কোটি হাত তো আছে। তাকে যদি প্রকৃত অর্থে কাজে লাগানো হয়, তাহলে আমাদের জন্য অসম্ভব তো কিছুই নয়। কিন্তু সেই সম্ভবটাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে যে সংস্কারগুলো দরকার, সেগুলো তো করতে হবে। সব হতাশার পরেও আমি মনে করি, ৩৪ কোটি হাত আছে। এমনকি কোনোদিন ঘটবেই না যে, এই হাতগুলো যখন যা করা দরকার তা করে ফেলবে; যে করছে না তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে! নিশ্চয়ই করবে।
লেখক
কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ

Related Posts

en_USEnglish