ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে একই দিন দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার ছাত্রীকে তুলে নিয়েছিল অপহরণকারীরা। রোববার উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের চটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সদরের কুলিকুণ্ডা উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘটে এ ঘটনা। তাদের সবাইকে খালা পরিচয় দিয়ে শুরুতে বিদ্যালয় থেকে বের করে নেয় বোরকা পরা এক নারী। পরে চক্রের সদস্যদের হাতে তুলে দেয়। তবে চটিপাড়া বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী একজনের হাত কামড়ে পালিয়ে গিয়ে লোকজনকে জানায়। পরে এলাকাবাসী অন্যদের উদ্ধার করে। তবে অপহরণকারীদের কাউকে আটক করা যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ (রোববার) পর্যন্ত একই কায়দায় ১২ শিক্ষার্থীকে তুলে নেওয়া হয়। তাদের অনেককে মারধর করে গায়ে থাকা স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় উপজেলার বিদ্যালয়গুলোতে আসা কমিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ঘটনার শিকার অনেক শিশু বোরকা পরা কাউকে দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে।
ভুক্তভোগী চটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান আলিফার মা জান্নাত আক্তার রোববার রাতে সমকালকে বলেন, ‘আজ আমার মেয়ের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ভোলার নয়। এমন হলে মেয়ে স্কুলে পাঠাব কীভাবে! আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারাদিন কোনো খাওয়া-দাওয়া করেনি। বিষয়টি কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না সে।’ তিনি বলেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসন যদি ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে স্কুলে পাঠানো সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, রোববার সকালে ওই বিদ্যালয় থেকে আলিফার সঙ্গে তুলে নেওয়া হয় তৃতীয় শ্রেণির ইফরাত জাহার ইলমা ও চতুর্থ শ্রেণির তাযকিরাতুল তাহিয়াকে। বোরকা পরা এক নারী ‘খালা’ পরিচয় দিয়ে তাদের তিনজনকে বিদ্যালয়ের প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বেড়িবাঁধ এলাকায় নিয়ে যায়। পরে তাদের ৮ নারীর কাছে তুলে দেয় সে। সেখানে মারধর করা হয় তিন শিশুকে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তাযকিরাতুল তাহিয়া চক্রের এক সদস্যের হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন অন্যদের উদ্ধার করে।
ওই ছাত্রীরা জানায়, বোরকা পরা নারী তাদের বলে, ‘আমি তোমার খালা হই। তোমার মা বলছে আমার সঙ্গে বাড়িতে যেতে।’ তারা ওই নারীকে চেনে না জানালে ধমক দিয়ে বলে, ‘অ্যাই, বেশি কথা বলবি না। কোনো কথা বললে মেরে ফেলব।’
তাযকিরাতুল তাহিয়ার বাবা মো. আকবর উপজেলার নূরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি গতকাল সোমবার বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমার মেয়ে চরম আতঙ্কে আছে। কোনোভাবে বুঝিয়েই তাকে আজ স্কুলে পাঠাতে পারিনি।’
একই দিন উপজেলা সদরের কুলিকুণ্ডা উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জোর করে তুলে নেওয়া হয় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ঝুমুর আক্তারকে। সে চিৎকার করতে থাকলে বিদ্যালয়ের প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটি পরিত্যক্ত ঘরে রেখে পালিয়ে যায় চক্রটির সদস্যরা।
২৫ ফেব্রুয়ারি সদর ইউনিয়নের নাসিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মো. স্বাধীন মিয়া নিখোঁজ হয়। তার বাবা মো. আবদু মিয়া নাসিরনগর থানাকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি আশুগঞ্জ ফেরিঘাট থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। আবদু মিয়া বলছেন, এর পেছনে জিনের হাত রয়েছে। তবে এলাকাবাসী স্বাধীনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে একই চক্রকে সন্দেহ করছে।
২২ ফেব্রুয়ারি উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের ভোলাউক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হানা দেয় চক্রটির সদস্যরা। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলার মধ্যেই এক নারী ‘খালা’ পরিচয় দিয়ে কৌশলে বের করে নেয় দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আছমা আক্তার ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাত আক্তারকে। তাদের বিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে শিশুরা চিৎকার করে। এ সময় মুখ চেপে মারধর করে তাদের গা থেকে স্বর্ণালংকার নিয়ে দৌড়ে পালায় দুর্বৃত্তরা।
সূত্র জানায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা সদরের শিশু কানন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরছিল। পথে বোরকা পরা পাঁচ নারী তাদের পথ আটকায়। দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে এক নারী বলে, ‘আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। আমি তোমার খালা হই।’ কিন্তু শিশুটি তাকে না চেনায় দৌড়ে পালায়। তার সঙ্গে থানা তিন শিশুকে জোর করে গাড়িতে তোলার সময় এক পথচারী দেখে ফেলেন। তিনি শিশু রক্ষা করলেও, চক্রটির সদস্যরা পালিয়ে যায়।
এসব ঘটনার সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে শিশু ও অভিভাবকের মধ্যে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির সংখ্যা কমে গেছে। অনেক মা-বাবা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, ২৫ দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনার সংবাদ এলেও উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। এ কারণে তারা আতঙ্কিত। তবে পুলিশ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
চটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছায়েদুল হক বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্ন।’ কীভাবে এ সমস্যার সমাধান মিলবে বুঝতে পারছেন না। তাই অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনা করবেন।
গোকর্ণ ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ শাহীন বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান আলিফার বাড়িতে রোববার সাহায্য চাইতে ৪-৫ নারী যায়। তারা কৌশলে ওই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শিশুদের নাম জেনে ফেলে। পরে বিদ্যালয়ে গিয়ে নাম ধরে ডেকে তিনজনকে বের করে।
এ জনপ্রতিনিধির ধারণা, উপজেলার ধরমণ্ডল ইউনিয়নের একটি চক্র এসব ঘটনায় জড়িত। সারাদেশে নানা অপরাধমূলক ঘটনায় ওই ইউনিয়নের কিছু লোক জড়িত বলে সংবাদে এসেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি প্রশাসন কঠোর না হয়, তাহলে চক্রটি এলাকা থেকে শিশুদের পাচার করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
ভুক্তভোগী কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইকবাল মিয়া। তিনি এর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝে উঠতে পারছেন না। সব শিক্ষককে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
নাসিরনগর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহাগ রানা বলেন, কয়েকটি মৌখিক অভিযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে পুলিশের বেশ কয়েকটি দল মাঠে কাজ করছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইমরানুল হক বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ১২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অভিভাভকদের নিয়ে আলোচনা করবেন। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হতে অভিভাকদের পরামর্শ দেন তিনি।