রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন ও পুশইন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়ার আহবান জানিয়ে জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করেছে।
এ রেজুলেশনে মিয়ানমার সরকারের উপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।
রেজুলেশনটি জাতিসংঘ, মায়ানমারসহ বিশ্বের জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে প্রেরণ করা হবে।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনে সংসদে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ ও তাদের ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে আনীত ডা. দীপুমনির প্রস্তাবের (সাধারণ) ওপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে এই রেজুলেশন গৃহীত হয়। সরকার ও বিরোধী দলের ২২ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। এরআগে রেজুলেশন গ্রহণের ফলে কী লাভ হবে জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, রেজুলেশনটি জাতিসংঘ, মায়ানমারসহ বিশ্বের জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে প্রেরণ করা হবে। এর মাধ্যমে বিষয়টি আইনগত ভিত্তি পাবে এবং মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক সমাজ চাপ প্রয়োগ করার নৈতিক দায়ের সৃষ্টি হবে।
প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু ও ড. আলমীগর খান মহিউদ্দীন, জাসদের নির্বাহী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো: শাহরিয়ার আলম, এ বিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, জাসদের বেগম শিরীন আক্তার, ফখরুল ইমাম, মেজর জেনারেল এটিএম আবদুল ওয়াহহাব (অব:), কক্সবাজারের এমপি সাইমুম সারোয়ার কমল প্রমুখ।
কার্য প্রণালী বিধির ১৪৭ (১) ধারা অনুসারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. দীপুমনি এই প্রস্তাব গ্রহণের জন্য রবিবার নোটিশ প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর অব্যাহত নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধ, তাদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতারণ করে বাংলাদেশে পুশইন করা থেকে বিরত থাকা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমার সরকারের উপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো ক‚টনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহবান জানানো হোক।
বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ বলেন, রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি মানুষ হিসেবে। মুসলমান হিসেবে। ভারত এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন রোহিঙ্গারা আমাদের মেহমান। তবে যেভাবে তারা আসছে, তা আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। ওদের সাথে অস্ত্র চলে আসছে। মাদকও আসছে। এ বিষয়ে সরকারের আরো নজরদারি বাড়ানো উচিত। তাদের একটি জায়গায় রাখা উচিত। পরিচয়পত্র দেওয়া উচিত। চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা উচিত। অবশ্য এ বিষয়ে এরমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যেসব উদ্যো নেওয়া হয়েছে এবং হবে এর মাধ্যমে সমাধানের একটি পথ বেরিয়ে আসবে। তিনি নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির সমালোচনা করে বলেন, তিনি কী করে এমন অমানবিক কাজ করতে পারেন।
মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবে আশ্রয় দিয়েছি। মুসলমান হিসেবে নয়। ওদের সিদ্ধান্ত, ‘কিল দেম অল বার্ণ দেম অল’। তিনি জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, পাপুয়া নিউ গিনিতে আপনারা ৯৯ সালে ভোটাধিকারের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ওদের চামড়া সাদা ছিল। রোহিঙ্গাদের চামড়া কালো বলে ওদের আপনারা মানুষই মনে করছেন না। কিন্তু ওরাও মানুষ ওদের নাগরিকত্ব ও ভোটধিকারের ব্যবস্থা করুন। তিনি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছেন। ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে বিপদ মুক্ত রাখুন। আমরা সংঘাত চাই না।
ডা. দীপুমনি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর অব্যাহত নির্যাতন নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করায় সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির লাখ লাখ লোক ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার কেউ অর্ধমৃত, কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউ বা আবার ক্ষত বিক্ষত হাত পা নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু কোনো মতে জীবন নিয়ে ঢলের মতো প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। নাফ নদীতে ভাসছে সারি সারি রোহিঙ্গার লাশ। নিজ ভূমি থেকে রোহিঙ্গা জন গোষ্ঠিকে জাতিগতভাবে নির্মূলের লক্ষ্যে চালানো অব্যাহত নৃশংসতার গর্ভবতী মা বোনসহ দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও রেহায় দিচ্ছেন এ সকল বাহিনী। তাদেরকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে বাঙালি সন্ত্রাসী হিসেবে। এদের প্রতিটির বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে নিজভূমিতে ফিরতে না পারে। মানবিক কারণে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দুর্দশাগ্রস্থ এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে।
তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী। তারা ৫’শ বছরের অধিক সময় ধরে আরাকান রাজ্যে বসবাস করছেন। তিনি আরাকান রাজ্যের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে আরাকান ছিল স্বাধীন মুসলিম রাজ্য। ১৪০৪ সাল থেকে ১৬১২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম সম্রাট আরাকান শাসন করেছেন। রাজা বোধাপোয়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে তৎকালীন বার্মার সঙ্গে যুক্ত করেন। ১৯৪৮ সালে ইউনিয়ন অব বার্মা বৃটিশদের কাছ থকে স্বাধীনতা লাভের সময়ও আরাকান বার্মার অংশ থেকে যায়।