ভালো থেকো; দেখা হবে জান্নাতে

image_pdfimage_print

সৈয়দ আফসার উদ্দিন। পরিবার ও স্বজনদের কাছে মিঠু নামেই যার পরিচিতি। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের অত্যন্ত পরিচিত ও প্রিয়মুখ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার এবং কমিউনিটি কর্মী। অন্য আর দশজনের মতো অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে এসেছিলেন এই দুনিয়ায়। তার মৃত্যু চুরমার করে দিয়েছে আমার ভেতরটা। এই ব্যথা কাউকে বোঝানোর না। আমার গর্ব করার জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি।

তুমি চলে যাওয়ার পরে ভাবী (প্রয়াত সৈয়দ আফসার উদ্দিন মিঠুর স্ত্রী) আম্মাকে বলেছে, ‘আপনি অনেক ভাগ্যবতী যে আপনার ছেলে মা ছাড়া কিছুই বুঝত না। আল্লাহ্ যেন সকল মাকে আপনার এই ছেলের মতো সন্তান দান করেন।’ তুমি জীবনের চেয়েও বড় ছিলে। তুমি ছিলে ভালোবাসায় ভরা একটা মানুষ। তুমি তোমার ক্যান্সারকে পরাজিত করে প্রায় ৯ বছর আমাদের সময় ও ভালোবাসা দিয়েছো। কথা আর লেখা দিয়ে তোমার ভালোবাসার ঋণ কখনও শোধ হবে না।


আমরা কাছের অনেকেই তোমাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি, তুমি না থাকলে আমার জাপান থেকে ইংল্যান্ডে আসা হতো না। আমার কোয়ালিফিকেশন ও প্রফেশন নিয়ে তুমি ছিলে গর্বিত, যেমন গর্ব করতা তোমার দুই ভাতিজা ও ভাগিনা-ভাগনিকে নিয়ে। তোমার কাছ থেকে অনেক শিখেছি, ধন্যবাদ। তুমি আমাদের নিয়মিত হাসিয়েছিলে এবং জীবনকে মজার বানিয়েছিলে। তুমি ছিলে আমাদের যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানের তারকা। তোমাকে কখনও একজন বাবা হিসেবে, কখনও একজন স্বামীর ভূমিকায়, কখনও সন্তান, ভাই, চাচা, মামা, খালু এবং ফুপা হিসেবে দেখে অনেক শিখেছি।
তুমি সর্বদাই তোমার সন্তানদের বুকে রেখেছিলে। মা-বাবার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিলো অতুলনীয়। এমন দিন নেই যে তুমি আম্মাকে ফোন দাওনি। তোমার সমান কখনও হতে পারব না, আল্লাহর প্রতি তোমার অনেক অনেক ভয় ছিল। এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে তোমাকে কিছু বোঝানো ছিল আমার জন্য পানিভাত। একটি মানুষ তোমার বিরুদ্ধে পেলাম না, এটা ছিল তোমার বিরাট অর্জন। তুমি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা ছিলে। তুমি জুমার রাতে দুনিয়া ছাড়তে চেয়েছিলে, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেছেন।

তুমি অনেক বিনয়ী ছিলে। মূলত আমি ছিলাম তোমার আদরের ছোট ভাই। কিন্তু তোমার অতি বিনয়ের কারণে আমি বড় ভাইয়ের ভূমিকা রাখতাম। আমরা দুজন বন্ধুও ছিলাম বটে! আরও ছিলাম দুজনে দুজনার ভায়রা ভাই। আমাদের ভুল বোঝাবুঝি একটা ফোন কলে শেষ হয়ে যেতো। তোমার খবর পড়ার স্টাইল ছিল ইউনিক। আমার চোখে, ‘আপনি কেবল যুক্তরাজ্যের সেরা বাংলা সংবাদ পাঠক ছিলেন’। খবর পড়ার প্রতি তোমার উৎসর্গ বলে শেষ হবে না।
তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে বিলেতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং ব্রিটিশ বাংলা মিডিয়াতে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতস্বরূপ আজীবন সম্মাননা পাওয়া চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার চিনকি আস্তানার তাকিয়া বাড়িতে (সৈয়দ বাড়ি) এই সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। আমরা ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনের প্রথম স্যাটেলাইট বাংলা টিভি চ্যানেল, বাংলা টিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে তিনি নিজেকে সংযুক্ত করেন।

বাংলাদেশে থাকাকালীন সংবাদ ও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক গ্রুপের স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ও উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটেনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওতে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, খেলাধুলা এবং ম্যাগাজিন প্রোগ্রামে কাজ করেছেন আট বছর। চার বছরের জন্য ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওর লন্ডন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। শিক্ষকতায় তার রয়েছে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা। বাংলাসহ পাঁচটি বিষয়ে ইয়ার সেভেন থেকে এ লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন হেড অব ইয়ার এবং ডাইরেক্টর অব স্কুল হিসেবে কাজ করেছেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিন বছর আগে বাধ্য হয়ে তাকে অবসরে যেতে হয়। পাশাপাশি জিসিএসই বাংলার পরীক্ষক হিসেবে একিউএ এক্সাম বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সন্ধ্যাকালীন চাকরি হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইএসওএল লেকচারার হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটস্ কলেজে কাজ করেন।

তোমার প্রতি তোমার সহকর্মীদের প্রাণভরা ভালবাসা দেখে প্রাণ ছুঁয়ে গেছে। আত্বীয়-স্বজন ও তোমার দেশ-বিদেশের বন্ধুরা তোমাকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। আমার নিয়মিত খোঁজ নেয়ার কিংবা আবেগ দেখানোর আর কেউ রইল না। কেউ আর জানতে চাইবে না, কবে আবার ব্রিস্টল থেকে লন্ডনে যাব, কিংবা লন্ডন থেকে বাসায় গিয়ে ঠিকঠাকমতো ফিরেছি কিনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর কথা বলা হবে না। অভিমান-অভিযোগও আর কেউ করবে না।

হাসপাতালে আমার কপালে দেয়া তোমার শেষ চুমু আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। মহান আল্লাহ্ তোমাকে বেহেস্ত নছিব করুন। তোমার মতো ভালো লোকদের আল্লাহ অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন। ইনশাআল্লাহ্, তোমার সঙ্গে দেখা হবে জান্নাতে।

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BDবাংলা