এই শক্তি ও অনুপ্রেরণা ইতিহাসের দান

image_pdfimage_print

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরো সময়ের মধ্যে ডিসেম্বর মাসটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৫ ডিসেম্বর ছিল রোববার। সর্বাত্মক লড়াইয়ে এদিন শত্রুমুক্ত হয় বাংলার আকাশ। মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখলে নেয়। সারা দিন ভারতীয় জঙ্গিবিমান পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোয় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। এর একদিন পরই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে রয়েছে নানা মোড়। আজও ছড়িয়ে আছে যুদ্ধের অনেক না জানা ইতিহাস, ত্যাগরে কাহিনি।

মহান মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করেন গবেষক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি এখনো আমাদের হানা দেয়। যখন পেছনদিকে তাকাই, তখন অনেক কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়। একটি স্মৃতি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা পেল। আমরা এই জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি।

এই জাদুঘর সর্বজনের সমর্থন পেয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই জাদুঘর করার পেছনে যে চ্যালেঞ্জ ছিল, তা হলো উপকরণ আহরণ ও সংরক্ষণ করা। আর সে দায়িত্ব আমরা পালন করছি। আমার খুব মনে পড়ে নিজামউদ্দিন আজাদের কথা। ১৯৭১ সালে সে ছিল আমাদের অনুজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছোট ভাই। মিটিংয়ে, মিছিলে আজাদ সব সময় সামনের সারিতে থাকে। সব সময় স্লোগান দেয়, দেখতে সুদর্শন। আজাদের বাবা কামরুদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট আইনজীবী। অনেকভাবে আজাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমরা একত্রে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেদিন রাতে যে আক্রমণ হলো তাতে প্রতিরোধের প্রয়াসগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরা নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ি। তারপর কারফিউ উঠল অল্প সময়ের জন্য। প্রথমদিন সম্ভবত ঘণ্টা দুয়েকের জন্য এবং তারপর আরেকটু বাড়তি সময়। দ্বিতীয়বারের জন্য যখন কারফিউ উঠল, তখন আজাদ এসেছিল আমার বাসায়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করছিলাম। আজাদ ছোট্ট রুমালে বাঁধা একটা পুঁটলির মতো নিয়ে এসেছিল। আমাকে বলল, সে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি বাহনীর হত্যাযজ্ঞ নিজে দেখে এসেছে।

গিয়েছিল শিববাড়ীতে যে কোয়ার্টারে মধু দাকে হত্যা করা হয়। ও দুই ঘণ্টায় যখন কারফিউ শেষ হলো, সে তখনই ওখানে যায়। মধু দার ফ্ল্যাটেও সে ঢুকেছিল। সেখানে রক্তের চিহ্ন, দেওয়ালে বুটেলের চিহ্ন দেখেছে। সেখান থেকে কয়েকটা বুলেটের খোসা তুলে এনেছিল। সেটাই রুমালে করে নিয়ে এসে আমাকে দেখাল। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার যে প্রয়াস আমরা ২৫ বছর পরে নিয়েছিলাম, সেই কাজটা সে ২৫ মার্চের পরই শুরু করেছিল। সেই আজাদও ১১ নভেম্বর শহিদ হলো। এ স্মারকগুলো যখন দেখি, তখন স্মৃতিকাতর হই, একধরনের আকুলতা কাজ করে। সব মিলিয়ে মনে হয়, আজাদের কাজটাই যেন আমরা এখন করছি। আজাদ নেই; কিন্তু তবুও যেন আজাদ আছে আমাদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আজাদের লাশ পাওয়া যায়নি। কেনো আনুষ্ঠানিক দাফনও হয়নি। এরকমভাবে যারা হারিয়ে গেছে, তাদের মায়েরা কিন্তু আশা ছাড়েননি। আজাদের মা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা ছাড়েননি, অপেক্ষা করেছেন। তার ছেলে বেঁচে আছে এবং ফিরে আসবে।

মফিদুল হক বলেন, এই যে একটা অসাধারণ লড়াই এবং তার পরতে পরতে এতকিছু জড়িয়ে আছে, সেটা যেন বহমান থাকে। নবীনরা যেন এটা অনুধাবন করতে পারে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তারা নিজেরাই শক্তি খুঁজে পাবে। বহু বাধা চড়াই-উতরাই তো জীবনে থাকেই। কিন্তু এই যে একটা প্রেরণা এবং শক্তি, যা আমাদের ইতিহাস আমাদের জুগিয়েছে। আমরা যেন এই ইতিহাসের প্রতি অবহেলা না করি এবং শক্তিটা যেন ধারণ করার চেষ্টা করি।

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BDবাংলা