রাহুলের যাত্রায় মোদি-উত্তর ভারতের ইঙ্গিত দিচ্ছে

ভারতের স্বাধীনতার নায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সুস্পষ্ট অনুকরণে দেশটির প্রধান বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বর্তমানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলমান পদচারণার শেষ পর্যায়ে আছেন। সমালোচক ও সংশয়বাদীদের উপেক্ষা করে তাঁর কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটে অতিক্রমের এ যাত্রা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও জনসমাবেশের দিক থেকে সফল হয়েছে। তিন মাস ধরে ভারত জোড়ো যাত্রা বা ভারতের ঐক্যের জন্য এ পদযাত্রা সচেতন মানুষদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।

পদযাত্রাটি মঙ্গলবার রাতে উত্তরের পাঞ্জাব রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এ পথেই এটি তার সমাপ্তি টানতে ভারত শাসিত কাশ্মীরের উচ্চশিখরে পৌঁছবে। এত দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখ রাহুল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিচ্ছেন; প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথরেখাও তৈরি হচ্ছে এ পদযাত্রায়।

যাত্রা শব্দটি ভারতে সাধারণত হিন্দু তীর্থযাত্রা বোঝাতে ব্যবহূত হয়। তবে রাহুলের এ যাত্রার লক্ষ্য রাজনৈতিক মুক্তি। এটি কংগ্রেস দলকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যাঁকে ধারাবাহিক নির্বাচনী পরাজয় এক দশক ধরে প্রায় স্থবির করে রেখেছিল। বিজেপি যাঁকে বরাবর অপেশাদার রাজনীতিবিদ হিসেবে আখ্যায়িত শুধু নয়, নির্দয় উপহাসও করে আসছে; সেই রাহুল আজ গণআবেদনধারী একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত।

আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সবার জন্য সমৃদ্ধির একটি সহজ বার্তা নিয়ে চলমান এ মহাকাব্যিক পদযাত্রার মূল মনোযোগ হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে জঙ্গমক্রিয়ার ওপর। প্রতিদিন প্রতিটি যাত্রাবিরতিতে রাহুলের সহকারীরা তাঁদের নেতার সঙ্গে কৃষক ও শ্রমিক, যুবক ও বৃদ্ধ, পুরুষ ও নারী, এমনকি শিশুদের সঙ্গেও মোদি সরকারের অধীনে তাদের ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন সম্পর্কে যে কথোপকথন হয়, তা নথিবদ্ধ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এগুলো ভারতীয় অর্থনীতির জীবন্ত বাস্তবতার খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরে; যেখানে উচ্চ বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ম্ফীতির কথা উঠে আসে। যে সরকারের আমলে এটা ঘটছে, সে প্রতিশ্রুতিতে চ্যাম্পিয়ন হলেও তার বাস্তবায়নে খুবই দুর্বল।

রাহুল গান্ধীর বার্তা হলো- মোদির প্রবল হিন্দুত্ব ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এসব বার্তার পাশাপাশি দাড়িওয়ালা বিরোধী নেতার সঙ্গে মানুষের আলিঙ্গন ও সেলফির জন্য হুড়াহুড়ি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পাশাপাশি মিডিয়াতেও নতুন এক ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে, যা এতদিন ছিল মোদির একচেটিয়া দখলে। আট বছর আগে ক্ষমতায় আরোহণের পর এই প্রথম মোদি এক ধরনের নীরবতা পালন করছেন। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে কিছুই বলছেন না তিনি।


রাজনৈতিক এ বার্তা প্রকৃতপক্ষে বহুসংস্কৃতি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং হিন্দু আধিপত্যবাদী নীতির মধ্যে সংঘর্ষের কথা বলছে। কিন্তু এটি স্পষ্ট- এ পদযাত্রা সেই যুদ্ধের কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে; যার এক প্রান্তে আছেন একজন, যিনি ভারতীয়দের চাঙ্গা করছেন এবং অপর প্রান্তে আছেন তিনি, যিনি তাঁদের বিভক্ত করছেন।

মোদি ও বিজেপি দীর্ঘকাল ধরে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসছে; যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কার্যত প্রতিনিধি গান্ধী পরিবার। ওদের বক্তব্য হলো, গান্ধী পরিবার ভারতকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষয়িষুষ্ণ করে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে দেশটিকে বিশ্বব্যবস্থায় তার যোগ্য স্থান থেকে বঞ্চিত করেছে। রাহুল গান্ধীর প্রমাতামহ জওহরলাল নেহরু, দাদি ইন্দিরা গান্ধী এবং বাবা রাজীব গান্ধী- সবাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এসব জপেই মোদি ২০১৪ ও ‘১৯ সালের নির্বাচনে বিশাল ম্যান্ডেট পেয়ে যান এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত রাজনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে ব্যবহার করে তাঁর সহিংস হিন্দুত্বকে আড়ালের সুযোগ তৈরি করেন। মোদি নিজেকে একজন শক্তিশালী কিন্তু জনতুষ্টিবাদী হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি এই তথাকথিত প্রাচীন শাসনের বিরুদ্ধে উঠে এসেছেন। বর্তমানে আইন থেকে রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি- সবখানেই মোদি ভারতের জন্য একটি আগ্রাসী ‘হিন্দু প্রথম’ এজেন্ডা মূর্ত করে চলেছেন। নাগরিকত্বে ধর্মীয় বৈষম্য প্রবর্তনকারী প্রস্তাবিত আইন থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিয়মিত সহিংসতা- সবখানে মোদির এজেন্ডা হলো, ভারতকে ঢেলে সাজিয়ে একটি মাত্র সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো।

৫২ বছর বয়সী রাহুল গান্ধী দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজবংশের চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে নিন্দিত হয়েছেন। তবুও বিশেষত তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের কারণে ক্ষমতা ও সহিংসতা সম্পর্কে রাহুলেরই দীর্ঘ ও নিবিড় জ্ঞান রয়েছে। তাঁর দাদি ও বাবা দু’জনকেই হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ক্ষমতার ফাঁদ এড়িয়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মোদির শক্তিশালী কৌশলগুলো সফলভাবে মোকাবিলা তখনই করা যাবে যখন এসব অপকৌশলের ভুক্তভোগী মানুষ একসঙ্গে দাঁড়াবে এবং হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে সামান্যতম সমালোচকদেরও- যাঁরা এ হিন্দুত্বের কারণে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন; এক ছাতার নিচে আনা যাবে।

মোদি কর্তৃত্ব ও জনতুষ্টিবাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকাশ করে চলেছেন। অন্যদিকে রাহুল জনগণের সঙ্গে একটি সহানুভূতিশীল সংযোগ তৈরি করতে চাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে একটি আনুভূমিক মৈত্রীর সন্ধানরত এ যাত্রার বার্তা হলো- নির্ভীকতার রাজনীতিকে শক্তিশালীকরণ। এটি করার মাধ্যমে যাত্রা স্বাধীন ভারতের ভিত্তি বলে পরিচিত বৈচিত্র্য ও ন্যায্যতার নীতিগুলোকে পুনঃআবিস্কার করতে চায়। লক্ষণীয়, এ যাত্রা সহিংসতা এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির প্রভাবশালী আখ্যানকে ভোঁতা এবং মোকাবিলা করার জন্য প্রেম, মৈত্রী ও ত্যাগের মতো আবেগধর্ম এক সহজ রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের ওপর জোর দিয়েছে।

প্রায় এক শতক আগে জাতির পিতা গান্ধীর বিখ্যাত লবণ যাত্রা (সল্ট মার্চ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং ভারতীয় রাজনৈতিক অভিজাতদের একইভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কারণ তিনি রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ক্ষমতা পরিত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ ভারতীয়দের সাহসী আশায় আলোকিত করেছিলেন। তিনি রাজনীতির রূপান্তর এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা খুঁজছিলেন। নিঃসন্দেহে তিনি তাতে সফল হয়েছিলেন।

দুই গান্ধীর মধ্যে তুলনা করা হলে তা নিশ্চয়ই হাস্যকর ও বোকামি হবে। আজকের প্রতিযোগিতা কোনো বিদেশি সাম্রাজ্যিক শক্তিকে উৎখাত করা নিয়ে নয়। এটি ভারতের ভবিষ্যৎ পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ও নিবিড় পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

কিন্তু মোদি ও বিজেপির দেখানো পথের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পথ দেখানোর মাধ্যমে ভারত জোড়ো যাত্রা ২০২৪ সালের নির্বাচনী যুদ্ধে লড়ার একটি মোক্ষম কৌশল পেতে সাহায্য করেছে। প্রায় এক দশক ধরে মোদি ও হিন্দুত্ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকার পর ভারতীয় গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত আদর্শ, আবেগ ও ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক একটি সত্যিকারের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে মনে হয়।

স্রুতি কাপিলা: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক; আলজাজিরা ডটকম থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BDবাংলা