মেঘনার ইলিশ আর পদ্মার ইলিশের মধ্যে তফাৎ কি?

জুনাইদ আল হাবিব:

নদীপ্রধান বাংলাদেশে মেঘনা আর পদ্মা নদী ইলিশ সম্পদের বিশাল ক্ষেত্র। এ জন্য মেঘনা ও পদ্মার সীমারেখায় এ পেশার মানুষদের সারিটাও বেশ লম্বা। সাধারণত পদ্মা আর মেঘনার ইলিশের মধ্যে যে পার্থক্যগুলো দেখা যায়, তা আমরা অনেকেই জানি না। ইলিশ বিশেষজ্ঞ লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মুহিবুল্লাহ বলছেন, সাগরের কাছাকাছি মোহনার ইলিশের স্বাদটাই বেশি। এ ইলিশ সাগরের মোহনা থেকে যত দূর যায়, তত তার ফ্যাট কমে যায়, যার সাথে স্বাদের বিষয়টাও জড়িত। সে দিক বিবেচনায় মেঘনার ইলিশের স্বাদ পদ্মার ইলিশের তুলনায় অনেক বেশি।

এ কর্মকর্তা আরো বলেন, সাগরের কাছে মোহনায় প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খাবার থাকে। যা মোহনার ইলিশ খেতে পারে। এতে তাদের পেট মোটা থাকে ও আকৃতি মধ্যম হয়। এটা বলতে গেলে মেঘনার ইলিশের বেলায় প্রযোজ্য। অন্যদিকে সাগর থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব অনেক। সাগর থেকে যত দূরত্বে ইলিশ উপরে আসবে তত ইলিশ খাবার কম পাবে এবং ইলিশের আকার লম্বা হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বলা চলা মেঘনার ইলিশ আর পদ্মার ইলিশ চেনার উপায় স্বাদ এবং আকৃতিতে।

মেঘনাতীরের মতিরহাট ইলিশঘাটের সাবেক সভাপতি ও কমলনগরের চর কালকিনি ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান মেহেদি হাসান লিটন নদীতে ইলিশ কম আসার কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, নদীতে ডুবোচরগুলোর কারণে ইলিশ আসতে সমস্যা। তিনি বলেন, নদীতে অসংখ্য ডুবোচর জেগে উঠার কারণে ইলিশ আসতে বাঁধা পায়। যার কারণে মেঘনায়ও বিগত বছরগুলোর তুলনায় ইলিশের পরিমাণ অনেক কমেছে। আর মেঘনায় ইলিশ না আসলে পদ্মায় যাবে কিভাবে৷ এ অবস্থার কারণে ইলিশ তাঁর গতিপথ বদল করে সাগরেই থাকছে। যার কারণে সাগর থেকে ঘাটে প্রচুর ইলিশ আসে। যেগুলোর স্বাদ নেই তেমন। যদি ডুবোচরগুলো খনন করা যেত, তাহলে অবাধে ইলিশ মেঘনার মোহনায় বিচরণ করতে পারতো। তাহলে ইলিশের উৎপাদনও বাড়তো, আমরা স্বাদের ইলিশ পেতাম। আর ইলিশের অভিযানের বিষয়েও আমাদের আপত্তি আছে। ইলিশের অভিযান আরো পিছিয়ে দেয়া উচিত।

সারা বছর ইলিশের মৌসুম বা মৌসুম ছাড়াও জেলেদের বিচরণ নদীগুলোতে চোখে পড়ে। তো এ পেশার মানুষগুলো কেমন আছেন? খোঁজ নিতে কথা হয়েছিলো মেঘনাপাড়ের মতিরহাট ইলিশ ঘাটের বেশ কয়েকজন জেলের সাথে। মেঘনায় ১৫বছর ধরে ইলিশ ধরেন জাহাঙ্গীর আলম(৩৭)। তিনি বলছিলেন, ইলিশ ধরে কোন রোকম(রকম) জীবনডা পার করি। চলতে অসুবিধা, খাইতে অসুবিধা। নদীতে কামাই করে মোটামুটি চলি। এই নৌকা কিনতে এক লাখ টাকা ঋণ নিছি, এখনো শোধ করতে পারিনাই। নদীতে মাছ কয় দিন আছে, কয় দিন নাই। ডাকাতের কারণে রাত নদীতে নাউ বাইতে পারি না। আমাদের আটকিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নেয় ডাকাতরা। মুখ থেকে কিছু বললেতো শেষ করে দিবে।

জেলে মুহম্মদ নুর নবী। বয়সের সীমানা ৬৫গড়িয়েছে। মেঘনায় ইলিশ ধরেন ২০বছর ধরে। শুরু থেকে অন্য মাঝিদের সাথে ইলিশ ধরলেও এখনো তার অবস্থার বদল হয়নি। তিনি বলেন, ইলিশ আমরা ধরি ঠিকই। লাভের বেলায় আমরা জিরো। এখানে মহাজনদের লাভ বেশি। আমরা দাদন নেই, ১৫হাজর, ২০হাজার করে। দাদন থেকে যে টাকা নেই, সেটাও শোধ করতে পারি না। কারণ, ইলিশ খুব কমই ধরা পড়ে। এ জেলে আরো জানান, মহাজনের কাছ থেকে ১লাখ টাকা দাদন নিলে ১০হাজার টাকা বছরে দিতে হয়। এছাড়াও নদীতে চোর-ডাকাতের আতংক, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের ভেতর আমাদের মাছ ধরতে নদীতে যেতে হয়। না গিয়েও পারি না। আশায় থাকি, অন্তত দুইটা মাছ পেলেও পেট চলবে। আমাদের অবস্থা এমনই থাকে। বদলায় না।

মেঘনায় ইলিশ শিকার করে বেঁচে থাকা এ জেলেদের জীবনটাও স্বাভাবিক সময়েও অস্বাভাবিক থাকে। দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানান সুযোগ-সু্বিধা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু জেলে এবং তাদের বিভিন্ন সংগঠনের কোন অভিযোগই যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে পৌঁছেই না।

জেলেদের অভিযোগ, নদীতে এসে কারেন্ট জাল পোড়ার প্রয়োজন কি। কারেন্ট জালের উৎপাদন ফ্যাক্টরি থেকে বন্ধ করে দিলেই ঝাটকা ইলিশ নিধন হবে না। এ ছাড়াও জেলেরা বলছেন, তাদের জন্য পর্যাপ্ত জেলে কার্ড নেই। যে সব জেলের জমি-জমা নেই, তাদের মাঝে চরের খাস জমি বন্টন করার দাবিও তুলছেন এসব জেলেরা।

ডুবোচর খনন করলে একদিকে যেমন নদীভাঙন ঠেকানো সম্ভব অন্যদিকে এ ইলিশের গতিপথ পরিবর্তন নিয়ে এক ধরণের সমাধানও মিলবে। আর অন্যদিকে জেলেদের যে সব দাবি দাওয়া রয়েছে, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে একদিকে যেমন জেলেদের জীবনের পরিবর্তন ঘটবে, ঠিক অন্যভাবে নদীতে ইলিশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BDবাংলা